২০১৮ সালের ১১ নভেম্বর থেকে ঝুড়িঝারা মাটির ঢিবিতে তিন মাসব্যাপী প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন পরিচালনা করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালকের কার্যালয়। এ কার্যালয়ের বিভিন্ন স্তরের কর্মচারী দিয়ে গঠিত ৬ সদস্যের একটি খনন দল কাজে অংশ নেয়। এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক। খননকাজ পরিচালনা করেন সহকারী পরিচালক। খননকাজে শ্রমিক হিসেবে মহাস্থানগড় থেকে নয় জন বিশেষভাবে পারদর্শী ও স্থানীয় ১৫ জন অংশ নেন।

জানা যায়, প্রায় ০.৫০ একর এলাকা খননের মাধ্যমে প্রত্ন ঢিবি থেকে মধ্যযুগীয় ইট নির্মিত একটি স্থাপত্য কাঠামো উন্মোচিত হয়। আলামত বিশ্লেষণ করে অনুমান করা যায়, স্থাপনাটি ৭ম শতকের দিকে নির্মিত কোনো বৌদ্ধ মন্দির হতে পারে। ক্রুশাকৃতির মন্দিরটি পূর্ব-পশ্চিমে ৯৯.৪০ মিটার ও উত্তর-দক্ষিণে ৯৫.৪০ মিটার। কেন্দ্রীয় গর্ভগৃহসহ ছোট-বড় প্রায় ৩৩টি কক্ষ প্রদক্ষিণ পথ ও পশ্চিম দিকে মন্দিরের প্রবেশপথ আবিষ্কৃত হয়েছে। সম্প্রতি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ফলে ঢিবিটি অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। যদিও চারপশের ভূমি থেকে এখনো ৩ মিটারের মত টিকে আছে। কিন্তু ঢিবিটি মোট উচ্চতা বিগত এক দশকে প্রায় ৩-৪ মিটারের মতো কমে গেছে। প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুর মধ্যে মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ, পোড়ামাটির গুটিকা, জালের কাটি, স্বল্প মূল্যবান পাথর ও কাচের গুটিকা, অলঙ্কৃত ইট, পোড়ামাটির খেলনা, ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের মুদ্রা ইত্যাদি পাওয়া গেছে। মৃৎপাত্রের মধ্যে সুলতানি আমলের প্লেট, বাটি, পানপাত্র, নলযুক্ত পাত্র ইত্যাদি পাওয়া যায়। এখানে প্রাপ্ত মৃৎপাত্রের সাথে ভরতভায়না ও দমদম পীরস্থানে প্রাপ্ত মৃৎপাত্রের পাশাপাশি মহাস্থানগড় ও জগজ্জীবনপুরে প্রাপ্ত মৃৎপাত্রের সাদৃশ্য রয়েছে।

এ বিষয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন দলের সদস্য, প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের আঞ্চলিক পরিচালকের কার্যালয় খুলনা ও বরিশাল বিভাগের কাস্টোডিয়ান মো. শাহীন আলম বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে পুরো প্রত্নস্থানটিকে আমরা কয়েকটি গ্রীডে ভাগ করে নেই। এরপর হ্যারিস ম্যাট্রিক্স পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রেক্ষিত ধরে ধরে উৎখনন কাজ পরিচালনা করা হয়। আন্তজার্তিকভাবে এখন পর্যন্ত এটি উৎখননের জন্য স্বীকৃত কার্যকর পদ্ধতি। খননের ফলে এখানে ১৪টি স্তর বা প্রেক্ষিত পাওয়া গেছে। যা তিনটি কালপর্বকে প্রতিনিধিত্ব করেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত জরিপের মাধ্যমে ঝুড়িঝারা ঢিবি খুঁজে পাওয়া যায়। ২০১২ সালে ঢিবিটি সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়। প্রায় ডিম্বাকৃতির ঢিবিটি সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ৫ মিটার উঁচু। ঢিবির উপরে মাঝারি থেকে বড় আকৃতির বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ রয়েছে। বেশ কয়েক বছর আগে ঢিবির উপর মাটি ফেলে তার ওপর প্রচুর খেঁজুর গাছ লাগানো হয়েছিল। অবতল আকৃতির ঢিবিটি ক্রমশ ঢালু হয়ে চারপাশের ভূমির সাথে মিশেছে। পূর্বদিকে কপোতাক্ষ নদের প্রাচীন মরা খাত ও দক্ষিণদিকে বিষকরম নামে একটি বড় দিঘী রয়েছে।’

খননদলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা একেএম সাইফুর রহমান বলেন, ‘সাতক্ষীরা অঞ্চলে এর আগে কখনো প্রত্নতাত্ত্বিক খনন পরিচালিত হয়নি। অথচ সাতক্ষীরা অঞ্চল ও এর আশেপাশে বেশকিছু প্রত্নস্থান ও প্রত্নঢিবি প্রাথমিক জরিপে আবিষ্কৃত হয়। যেখানে মুসলিমপূর্ব যুগের প্রত্ন আলামত পাওয়া যায়। এছাড়াও এ অঞ্চল এক সময়ে সুন্দরবনের অংশ ছিল। যার ফলে সুন্দরবনের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রেও এ খনন গুরুত্ব রাখে। সম্প্রতি সুন্দরবনে প্রত্নস্থান থাকার বিষয়ে জানতে পেরেছি। যদিও সতীশ চন্দ্র মিত্রসহ অনেক গবেষক বহু আগে সুন্দরবনে প্রত্নস্থান প্রাপ্তির উল্লেখ করেন। এ সব প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য-উপাত্তকে বিশ্লেষণ করে একটি সামগ্রিক আঞ্চলিক ইতিহাস রচনা করার জন্য ঝুড়িঝারা ঢিবিকে বেছে নেওয়া হয় খনন পরিচালনার জন্য। ইতোমধ্যে আমরা বেশকিছু আলামত পেয়েছি। যা অন্য কোনো প্রত্নস্থানে পাওয়া যায়নি।’

‘বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রত্নস্থানের মত এ ঢিবি নিয়েও স্থানীয় জনগণের মধ্যে নানা কুসংস্কার, কল্পকাহিনি ও কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে। বেশিরভাগ মানুষ মনে করে ঢিবির দক্ষিণ পাশের পুকুরটি জ্বিনেরা খনন করেছে। পুকুর খনন করার পর ব্যবহৃত ঝুড়ি ঝারার ফলে মাটি জমা হয়ে ঢিবিটি সৃষ্টি হয়।’

এ বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক ও উৎখনন কাজের তত্ত্বাবধায়ক আফরোজা খান মিতা বলেন, ‘মন্দিরটির স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যের সাথে যশোরের ভরতভায়না ও দমদম পীরস্থানের স্থাপত্য কাঠামোর সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও মৃৎ পাথর ও অন্যান্য প্রত্নবস্তুর সন্নিবেশ থেকে অনুমান করা হয়, স্থাপনাটি আদি মধ্যযুগীয়। তবে এখানে আদি ঐতিহাসিক যুগের কিছু আলামত পাওয়া যায়। যা মন্দির স্থাপিত হওয়ার আগে এখানে মানব বসতি থাকার সাক্ষ্য বহন করে। ফলে প্রত্নস্থানটির বয়স এক থেকে দেড় হাজার বছর পিছিয়ে যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘ইতোমধ্যে প্রত্নস্থানটিকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমানে প্রত্নস্থানটি আকর্ষণীয় পর্যটন স্থানে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন প্রচুর পর্যটক এখানে বেড়াতে আসে। কিভাবে স্থানটিকে আরও পর্যটনবান্ধব করা যায়, সে বিষয়ে ভবিষ্যতে আরও কর্মসূচি হাতে নেওয়া হবে। যার মাধ্যমে শিগগিরই এ অঞ্চলে পর্যটন কেন্দ্রের বিকাশ ঘটবে।’