সুভাষচন্দ্র বসু, নেতাজি-দ্বিতীয় পর্ব

ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম নেতা। নেতাজি নামে বিশেষভাবে অভিহিত হয়ে থাকেন।

.

 

 

কাবুলে পৌঁছে সেদিনের মতো বিশ্রাম নিয়ে, পরদিন তিনি রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতের সাথে দেখা করেন। কিন্তু রুশ-রাষ্ট্রদূত তাঁকে কোনও সাহায্য করলেন না। কয়েকদিন ঘোরাঘুরির পর সুভাস বসু জার্মান দূতাবাসে গিয়ে রাষ্ট্রদূতের সাথে দেখা করলেন। জার্মান রাষ্ট্রদূত তাঁকে আশ্বাস দিলেও বার্লিনের অনুমতি লাগবে বলে জানালেন। এই সময় ভগৎ সিং তাঁর পূর্বপরিচিত উমিচাঁদের সাথে দেখা করেন। ইতিমধ্যে সুভাষ বসুর অন্তর্ধানের সংবাদ সবাই জেনে গেছে। ভগৎসিং সুভাষ বসুকে লুকিয়ে রাখার জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করলেন। প্রথমে উমিচাঁদ তাঁর এবং পরিবারের নিরাপত্তার জন্য অন্যত্র আশ্রয় খুঁজতে থাকেন। কিন্তু উভয়ই বহু চেষ্টা করে তেমন নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পেলেন না। শেষ পর্যন্ত উমিচাঁদের বাসায় আশ্রয় পেলেন তাঁর স্ত্রীর দয়ায়। এই সময় চোরাই পথে রুশ সীমান্ত অতিক্রম করার জন্য দালাল পাওয়ায়, সেই পথে আফগানিস্থান ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন এঁরা। কিন্তু শেষ মুহুর্তে বার্লিন থেকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পান। এরপর জার্মান এ্যাম্বেসীর নির্দেশক্রমে এঁরা ইতালির রাষ্ট্রদূত এ্যালবার্ট কোরানীর সাথে দেখা করেন। কিন্তু রাশিয়ার সাথে ব্রিটেনের কোনো ভুল বুঝাবুঝি হোক, এটা এড়ানোর জন্য রুশ এ্যাম্বেসী ভিসা দিতে গড়িমসি করছিলেন। ১২ মার্চ রুশ এ্যাম্বেসী সুভাস বোসের ভিসা দিতে সম্মত হয়। ১৭ মার্চ সিনর অরল্যান্ডো ম্যাজোট্টা নামে ইতালির পাসপোর্ট নিয়ে  সুভাষ বোস কাবুল ত্যাগ করেন। তিনি প্রথমে মস্কো আসেন। সেখানে তিনি সোভিয়েত রাশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান স্ট্যালিনের সাথে দেখা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন, পরে তিনি মস্কো থেকে রোমে আসেন এবং ২৮ মার্চ তিনি রোম থেকে বার্লিন পৌঁছান।

তিনি বার্লিনে মুক্ত ভারতীয় কেন্দ্র (Free India Center) গড়ে তোলেন। এই সময় তাঁর স্ত্রী এমিলি তাঁকে নানাভাবে সাহায্য করেন। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে এমিলি একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। এর নাম Anita Bose Pfaff । অনিতা বর্তমানে জার্মানীর অগসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপিকা।

১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে সুভাষ বসুর অন্তর্ধানের কারণে, সমগ্র ভারতে ফরওয়ার্ড ব্লক-কে নিষিদ্ধ করা হয় এবং ফরওয়ার্ড ব্লকের সকল রাজনৈতিক অফিস বন্ধ করে দেওয়া হয়। এছাড়া ফরওয়ার্ড ব্লক-এর নেতাকর্মীদের পুলিশি নজরাদারিতে রাখা হয়।

জার্মানীতে গিয়ে তিনি ভারতের স্বাধীনতার জন্য তিনি জার্মান চ্যান্সেলর এডলফ হিটলারের সাহায্য প্রার্থনা করেন। তাৎক্ষণিকভাবে জার্মান কিছু সাহায্য করলেও, কিন্তু ভারতের স্বাধীনতার ব্যাপারে হিটলারের উদাসিনতা তার মনোবল ভেঙ্গে দেয়। ফলে ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে সুভাষ বসু জার্মান ত্যাগ করেন। একটি জার্মান সাবমেরিনে চড়ে তিনি ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ২ জুলাই সিঙ্গাপুরে পৌছান।

ইতিমধ্যে ভারতীয় অপর একজন নেতা রাসবিহারী বসু, প্রবাসে একটি সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিলে। এই বাহিনীর নাম ছিল ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী (INA=Indian National Army) । ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ৪-৭ জুলাই সিঙ্গাপুরস্থ মহা-এশিয়া মিলনায়তনে ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের প্রধান নেতৃবৃন্দের মহাসভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রেসিডেন্ট বিপ্লবী রাসবিহারী বসু সভায় দাঁড়িয়ে, সুভাষচন্দ্র বসুর সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দেন। সেই সঙ্গে প্রবাসী সরকারের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে সুভাষ বসুকে স্থলাভিষিক্ত করার প্রস্তাব করেন। শেষ পর্যন্ত সবাই এই প্রস্তাব গ্রহণ করলে, সুভাষ বসু প্রবাসী সরকার এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক পদ লাভ করেন। উল্লেখ্য রাসবিহারী বসুর গড়া এই বাহিনীতে একটি আলাদা নারী বাহিনী (রানি লক্ষ্মীবাঈ কমব্যাট) ছিল। সব মিলিয়ে এই বাহিনীতে প্রায় ৮৫,০০০ হাজার সৈন্য ছিল। এই বাহি্নীর কর্তৃত্ব ছিল প্রাদেশিক সরকারের হাতে, যার নাম দেওয়া হয় “মুক্ত ভারতের প্রাদেশিক সরকার” (আরজি হুকুমাত-ই-আজাদ হিন্দ)। এই সেনাবাহিনী  ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ নামে সর্বাধিক পরিচিত।

১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ মার্চ ব্রিটিশ বাহিনীকে পরাজিত করে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ ইম্ফল ও কোহিমার পথে অগ্রসর হয়। ২১ মার্চ ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ ভারতভূমির মনিপুরে প্রবেশ করে। এই ফৌজের কার্যাবলী খুব দ্রুত ভারতব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।  যুদ্ধের শেষ দিকে জাপান আত্মসমর্পণ করলে, সুভাষ বসু এই বাহিনী প্রত্যাহার করেন। পরে তিনি এই বাহিনী ভেঙে দেন। ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে ফরমোসার তাইহোকু বিমান বন্দরে বিমান দুর্ঘটনায় তিনি মৃত্যবরণ করেন।